একরাম হত্যা
[মূল পরিকল্পনাকারী সম্পর্কে তথ্য প্রমাণ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে]

শাহজালাল রতন…
ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরামকে পৈশাচিকভাবে খুনের ঘটনায় সরাসরি কারা অংশ নিয়েছিল, তা পুলিশের কাছে মোটামুটি পরিষ্কার। অনেকেই এরই মধ্যে ধরা পড়েছে। তারা অনেক তথ্যও দিয়েছে পুলিশকে। কিন্তু এ খুনের নেপথ্যের মূল খলনায়ক কে বা কারা_ জনমনে সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। তদন্ত সূত্র বলছে, এরই মধ্যে সেই খলনায়কদেরও কমবেশি তারা চিনতে পারছে। খলনায়কদের বিরুদ্ধে গ্রহণযোগ্য কিছু তথ্য-প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে। তবে তারা রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে খুবই প্রভাবশালী। তদন্তকারীদের ভাষায়, এদের ধরতে গেলে উচ্চ পর্যায়ের গ্রিন সিগন্যাল (সবুজ সংকেত) লাগবে। সেই সংকেতের প্রতীক্ষায় আছেন তারা। এদিকে, গতকাল বুধবার ফুলগাজীর বিএনপি নেতা মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী মিনারকে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। একরামকে হত্যার সঙ্গে জড়িত আরও একজনকে গতকাল গ্রেফতার করা হয়।গ্রিন সিগন্যালের অপেক্ষায় পুলিশ

কিলিং মিশনে চতুর্থ ও পঞ্চম স্তর :তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, একরাম কিলিং মিশন বাস্তবায়নে পাঁচটি স্তর ছিল। সর্বোচ্চ বা পঞ্চম স্তর থেকে খুনের মূল পরিকল্পনা আসে। এরাই হলেন সেই রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি, যাদের ধরতে গেলেশীর্ষ পর্যায়ের সবুজ সংকেত লাগবে। খুনের নির্দেশ এ পর্যায় থেকে আসে। তদন্ত সূত্র তাদের নাম বলতে চাইছেন না। তবে তারা আকার-ইঙ্গিতে বলছেন, ঘুরেফিরে আলোচনায় তাদের নাম রয়েছে।

সূত্র বলছে, চতুর্থ স্তর থেকে খুনের জন্য অর্থ সরবরাহ করা হয় এবং খুনের নীলনকশা তৈরি করা হয়। তৃতীয় স্তর থেকে প্রথম স্তর পর্যন্ত সম্পৃক্তরা মূলত কিলিং মিশন বাস্তবায়নে মাঠে দায়িত্ব পালন করে। সূত্র জানায়, তৃতীয় স্তরে ছিলেন জিহাদ চৌধুরী, কাউন্সিলর শিবলু ও জিয়াউল আলম মিস্টার। এ তিনজন খুনের জন্য সন্ত্রাসী ভাড়া করেন এবং খুনের পর তাদের প্রাথমিকভাবে রক্ষার জন্য যাবতীয় কৌশল ঠিক করেন।

দ্বিতীয় স্তরে ছিল কিলিং মিশনের খুনিরা, যারা সরাসরি গুলি করেছে, বোমা ফাটিয়েছে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়েছে, আঘাত করেছে এবং আগুন দিয়েছে। এ স্তরের নেতৃত্ব দেয় আবিদ। দ্বিতীয় স্তরে ছিল প্রায় ২০-২২ জনের একটি দল। এদের মধ্যে অনেকেই এর আগে ভাড়ায় খুনসহ অন্যান্য অপরাধ করেছে। একেবারে নিচের স্তরে ছিল প্রায় ২০/২৫ জন, যারা ঘটনার আগের রাত থেকে একরামের গতিবিধি অনুসরণ করছিল। ঘটনার দিন একাডেমি সড়কে একরামের গাড়ি আটকানো পর্যন্ত তারা দায়িত্ব পালন করে। এ স্তরের অনেকেই আগে থেকে জানত না যে একরাম খুন হবেন, নাকি তাকে মেরে আহত করা হবে। একরামের গতিবিধি নজর রাখা থেকে গাড়ি আটকানো পর্যন্তই তাদের দায়িত্ব ছিল। প্রথম স্তরের বেশিরভাগই খুনের পরপরই সটকে পড়ে। তদন্তে মূলত দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের অধিকাংশই গ্রেফতার হয়েছে।

সূত্র জানায়, এখন তৃতীয় স্তর থেকে চতুর্থ স্তরের জড়িতদের ধরার চেষ্টা চলছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের গ্রেফতারকৃতদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী চতুর্থ স্তরের দু’জনকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। এদের মধ্যে মাহতাব উদ্দিন মিনার চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আরেকজন ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল ঘটনার পর থেকে পলাতক। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তার বাসায় পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানেও তাকে ধরার জন্য বার্তা পাঠানো হয়েছে। স্থানীয়দের ধারণা, ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত আদেলকে কৌশলে বিদেশে পাঠানো হয়েছে। তদন্ত সূত্র জানায়, আদেলের অবস্থান সম্পর্কে এখনও তারা নিশ্চিত নন। তবে এখন পর্যন্ত তদন্তে খুনের জন্য অর্থ সরবরাহ করাসহ নীলনকশা তৈরির সঙ্গে আদেল সম্পৃক্ত ছিলেন, সেটা নিশ্চিত হওয়া গেছে। আদেলকে ধরা গেলে পঞ্চম স্তরে হত্যার মূল নির্দেশদাতা কে বা কারা ছিলেন, তা নিশ্চিত হওয়া যাবে।সংশ্লিষ্ট অপর একটি সূত্র জানায়, হত্যার মূল নির্দেশদাতা কে ছিলেন, সে সম্পর্কেও মোটামুটি ধারণা পাওয়া গেছে। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে তথ্য এবং সন্দেহভাজন প্রভাবশালীদের মোবাইল ফোনালাপের তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে পঞ্চম স্তরে নির্দেশদাতার পরিচয়ও অনেকটা অনুমান করা যাচ্ছে। তবে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ার কারণে এ স্তরে সম্পৃক্তদের ধরার জন্য প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায় থেকে সবুজ সংকেত প্রয়োজন। এ সূত্র আরও জানায়, খুনের নির্দেশদাতা তার প্রতিপক্ষ সবাইকে এক ধরনের বার্তা দিতে চেয়েছিলেন, যেন ভবিষ্যতে কেউ একরামের মতো তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস না পায়।

আলোচনার কেন্দ্রে নিজাম হাজারী :নৃশংস একরাম হত্যাকাণ্ডের পর ফেনীর সাধারণ মানুষের আলোচনায় আছেন ফেনী-২ আসনের এমপি নিজাম হাজারী। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস, নিজাম হাজারীর সিদ্ধান্তের বাইরে ফেনীতে কিছুই ঘটে না। এ কারণে তার জানার বাইরে একরাম হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটতে পারে_ এটা তারা বিশ্বাস করেন না। জনমনের এ ধারণাকে আরও উস্কে দিয়েছেন ফেনী-২ আসনের সাবেক এমপি ও ফেনীর একসময়ের গডফাদার হিসেবে পরিচিত জয়নাল হাজারী। হাজারীর সম্পাদিত স্থানীয় দৈনিক হাজারিকা প্রতিদিনে গত বুধবার লেখা হয়, নিজাম হাজারী আগের দিন একাধিক জাতীয় দৈনিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আবিদকে অনেকবার জেলে পাঠানোর যে দাবি করেছেন, তা ভুল। কারণ এর আগে অসংখ্য অপরাধ করলেও আবিদ জেলে যায়নি; বরং কিছুদিন আগে শহরে এক তরুণীর শ্লীলতাহানির চেষ্টার অপরাধে আবিদ গ্রেফতার হলে নিজাম হাজারী তাকে ছাড়িয়ে আনেন বলে হাজারিকা প্রতিদিনে লেখা হয়েছে। একরাম হত্যাকাণ্ডের পর থেকে ফেনীর দুই হাজারী একে অপরকে খুনের জন্য দায়ী করে আসছেন। যদিও দু’জনই দাবি করছেন, তারা নির্দোষ। পুলিশও এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগে গ্রহণযোগ্য কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি।

এই প্রভাবশালীদের গ্রেফতারে বাধা দিচ্ছে কে_ জানতে চাইলে তদন্ত দলের এক কর্মকর্তা এ বিষয়ে কিছু বলতে চাননি। শুধু বলেছেন, ‘আমরা গ্রিন সিগন্যালের অপেক্ষায় আছি।’ কিছুদিনের মধ্যে সবকিছুই পরিষ্কার হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।

মিনার চৌধুরী রিমান্ডে :নিহত একরামের ভাই জিয়াউল হক সেলিমের দায়ের করা মামলার প্রধান আসামি ফুলগাজীর বিএনপি নেতা মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী মিনারকে গতকাল বুধবার সকালেই ঢাকা থেকে ফেনী নিয়ে আসা হয়। মঙ্গলবার তাকে গ্রেফতার করা হয়। বুধবার বিকেলে ফেনীর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ খাইরুল আমীনের আদালতে আনা হয়। ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। একই সঙ্গে আগের দিন এ খুনের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার হওয়া স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রউফ ও সজীবকেও আদালতে হাজির করা হয়। রিমান্ড আবেদনের শুনানিতে পুলিশ মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে একরাম খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্য দেয়। পুলিশ আদালতকে জানায়, আবিদের ১৬৪ ধারা জবানবন্দি অনুযায়ী মিনার চৌধুরী এ খুনের জন্য জিহাদ চৌধুরীকে এক লাখ টাকা দিয়েছেন। এক লাখ টাকা থেকে আবিদও ২০ হাজার টাকা পায়। খুনের পরিকল্পনায় তার এবং তার সঙ্গে আরও কেউ জড়িত কি-না, তা জানার জন্য রিমান্ড প্রয়োজন। জবাবে মিনার চৌধুরীর আইনজীবীরা বলেন, মিনার চৌধুরী এলাকায় বিপুল দান-খয়রাত করেন। মাত্র এক লাখ টাকায় ৬০ জন যুবক এ ধরনের একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে, বিশ্বাসযোগ্য নয়। মিনার চৌধুরী ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ নানা জটিল রোগে ভুগছেন বলেও আইনজীবীরা জানান এবং রিমান্ড না দিয়ে জামিন দেওয়ার আবেদন করেন। শুনানি শেষে আদালত মিনার চৌধুরীর সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে তাকে সতর্কভাবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যও নির্দেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে অপর দু’জনের মধ্যে আবদুর রউফের পাঁচ দিনের ও সজীবের দু’দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।আদালত থেকে বেরিয়ে মিনার চৌধুরীর আইনজীবীদের পক্ষে অ্যাডভোকেট মেজবাহ উদ্দিন খান সাংবাদিকদের বলেন, উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও বিএনপি নেতা মিনার চৌধুরীকে এ মামলায় জড়ানো হয়েছে। বিশেষ কাউকে রক্ষার জন্যই মিনার চৌধুরীকে ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে বলেও তার অভিযোগ। এ সময় মিনার চৌধুরীর স্ত্রী মাহবুবা হাসনাত নাহরীন সাংবাদিকদের বলেন, তার স্বামী নির্দোষ এবং ভালো মানুষ। তার পক্ষে এ ধরনের অপরাধে জড়িত থাকার প্রশ্নই ওঠে না। স্বামী অসুস্থ_ এ বিষয়টি বিবেচনা করে এবং এ হত্যাকাণ্ডে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি। এ সময় মিনার চৌধুরীর বড় মেয়ে তনয়া তাজনীন, নাদিয়া নাতাশা ও মেহেরান মারিজিয়া কান্নায় ভেঙে পড়ে।

গ্রেফতার :একরাম কিলিং মিশনে থাকা আরেক সদস্য জিয়াউল হক বাপ্পীকে বুধবার গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পুলিশ জানায়, খুনের সময় বাপ্পী একরামকে ছুরিকাঘাত করেছিল। অন্যদিকে একরাম সমর্থকরা ফুলগাজী, মুন্সীরহাট ও বন্দুয়ায় একরাম মঞ্চের ব্যানারে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। কর্মসূচি থেকে একরামের খুনের নির্দেশদাতাকে গ্রেফতারের দাবি জানানো হয়।