বিশেষ প্রতিবেদক->>

ফেনীর ভূঞা ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির মালিক ও সমালোচিত পরিবহন শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ আলীর জামিন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। বৃহস্পতিবার দুপুরে ফেনী সদর আদালতের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আশেকুর রহমানের আদালতে উপস্থিত হয়ে জামিন চাইলে আদালতের বিচারক জামিন মঞ্জুর না করে কারাগারে প্রেরণ করে।

আদালত সূত্র জানায়, ফেনীর ভূঞা ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির মালিক ও সমালোচিত পরিবহন শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ আলী সহ তিন জনের বিরুদ্ধে ট্রাকে পরিবহনকৃত ফুল পেট সয়াবিন চুরির মামলা হয়। গত ৪ মে মঙ্গলবার লক্ষীপুরের রামগতি উপজেলার হাজী অজিউল্লাহ মিয়া ট্রেডার্সের সত্বাধিকারী আলতাফ হোসেন বাদী হয়ে ফেনী মডেল থানায় এ মামলা দায়ের করেন।

মামলার এজহার সূত্রে জানা যায়, এপ্রিল মাসের ৩০ তারিখে ফেনীর কসকা থেকে কুমিল্লার চান্দিনায় ৩১৫ বস্তা ফুল পেট সয়াবিন পাঠানোর জন্য ভূঞাঁ ট্রান্সপোর্টের একটি ট্রাক ভাড়া করা হয়। নিয়ম মোতাবেক ওই ট্রাক ৩ ঘন্টার মধ্যে কুমিল্লায় পৌঁছে মালামালগুলো চান্দিনার কাবিলাপুর মানহার অটো সয়াবিন এগ্রো লিমিটিড এর কাছে বুঝিয়ে দেয়া কথা। কিন্তুু দীর্ঘ ৬ ঘন্টা পরও সয়াবিনের ট্রাকটি চান্দিনায় পৌঁছেনি বলে মিল কর্তৃপক্ষ বাদী আলতাফ হোসেনকে জানায়। তিনি বিষয়টি ভূঞা ট্রান্সপোর্টের সত্বাধিকারীকে তাৎক্ষণিক বিষয়টি জানালেও তারা কোন সদুত্তর দিতে পারেনি।

বাদী আলতাফ হোসেন জানান, ওই ট্রাকে ১৩ লাখ ৫৩ হাজার ১শ টাকার সয়াবিন ছিলো। এসব সয়াবিন ট্রান্সপোর্টের মালিক মো. আলী, ড্রাইবার ইকবাল মিয়া ও হেলপার যোগসাজোশে আত্মসাত করেছে। এ ঘটনায় ফেনী মডেল থানায় তিনজনকে আসামী করে মামলা দায়ের করেছি।

ফেনী মডেল থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিজাম উদ্দিন (গত ৪ মে) জানান, সয়াবিন ভর্তি ট্রাকের হদিস না পেয়ে মোহাম্মদ আলীসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে আত্মসাত ও প্রতারণার অভিযোগ তুলে ভুক্তভোগী আলতাফ হোসেন থানায় এজহার দিয়েছেন। বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এদিকে মামলার আসামি হয়ে ফেনীর ভূঞা ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির মালিক ও সমালোচিত পরিবহন শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ আলী গ্রেপ্তার এড়াতে কিছুদিন গা ঢাকা দেয়। পরে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে ছিলেন। উচ্চ আদালতে জামিনের মেয়াদ শেষে বৃহস্পতিবার তিনি ফেনী জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্নসমপন করেন।

কে এই মোহাম্মদ আলী: 

তিন দশক আগে কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোট উপজেলা থেকে ফেনী শহরে ট্রাক চালকের সহকারী হিসেবে যোগ দেওয়া মোহাম্মদ আলী বর্তমানে স্বঘোষিত ফেনীর পরিবহন সেক্টরের ‘সম্রাট’। ট্রাক চালকের সহকারী থেকে ট্রাক চালক হয়ে স্থানীয় লতিফ ভূঁইয়া নামের এক ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেয় এবং ক্রমান্বয়ে উক্ত প্রতিষ্ঠানের পূর্ণ দায়িত্ব চলে আসে তার হাতে। কিছু রাজনৈতিক নেতার আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে ২০১৬ সালে জেলার ট্রাক, মিনিট্রাক, পিকআপ ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ সভাপতি পদে আসীন হয় মোহাম্মদ আলী। এক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ফেনীর পরিবহন সেক্টরে একচ্ছত্র আধিপত্য গড়ে তুলে। ফেনীর পরিবহন সেক্টরে তাঁর চাঁদাবাজি এখন ‘ওপেন সিক্রেট’।

ফেনী জেলা ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতির বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি, বেপরোয়া টোকেন চাঁদাবাজি, সরকারি জায়গা দখল, ট্রাকে পরিবহনকৃত মালামাল চুরি ও সাংগঠনিক স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়কের ফেনী অংশে চলাচলকারী ট্রাক, মিনিট্রাক, পিকআপ, ইমা ও কাভার্ডভ্যানে ‘ভূঞা ট্রান্সপোর্টের’ লোগোসংবলিত স্টিকার সাটিয়ে মাসে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করার অভিযোগ পাওয়া গেছে শ্রমিকলীগ নেতা মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল, সড়ক-মহাসড়কে আইনি ঝামেলা থেকে রেহাই পেতে আনুমানিক ৫ হাজারের বেশি ট্রাক, মিনিট্রাক, পিকআপ, ইমা ও কাভার্ডভ্যানে ‘ভূঞা ট্রান্সপোর্টের’ লোগোযুক্ত স্টিকার সাটানো যানবাহনের চলাচল করার চিত্র।

কি বলছেন মালিক-শ্রমিকরা:

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মালিক ও চালকদের অভিযোগ মাসিক ১ থেকে ৩ হাজার টাকা চুক্তিতে ‘ভূঞা ট্রান্সপোর্টের’ লোগো সংবলিত স্টিকার লাগাতে হয়। না হলে প্রতিনিয়ত পড়তে হয় ঝামেলায়। নতুন গাড়ি ভর্তির ক্ষেত্রে গুনতে হয় ৩ থেকে ১০ হাজার টাকা।

মালিক ও চালকদের অভিযোগ কৌশলে টোকনে চলছে চাঁদাবাজি, গাড়ির কাগজপএ ঠিক থাকার পরও গুনতে হচ্ছে দ্বিগুণ টাকা। বির্তকিত ও সমালোচিত শ্রমিকলীগ নেতা মোহাম্মদ আলী ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের ফেনী অংশে দেদারসে চালিয়ে যাচ্ছে টোকেন চাঁদাবাজি!

আইনের তোয়াক্কা না করে একের পর এক অপরাধ সংঘটিত করছে, যারমধ্যে সরকারি জায়গা দখল, টোকেন চাঁদাবাজি, দেবীপুরে সওজের জায়গা দখল, লালপোলে সড়কের জায়গা দখল করে ট্রাক ট্রার্মিনাল নির্মাণ ও সম্প্রতি ট্রাকে পরিবহনকৃত মালামাল চুরি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েও বহাল তবিয়তে থেকে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল প্রভাবশালী এই শ্রমিক নেতাকে।

মোহাম্মদ আলীর অনৈতিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে সাধারণ শ্রমিকরা জেলা ট্রাক-মিনিট্রাক পিকআপ ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনের দাবীতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মানববন্ধন ও সভাপতি কর্তৃক গঠনতন্ত্র বিরোধী অনিয়ম ও সাংগঠনিক স্বেচ্ছাচারিতায় বিষয়ে দুদক, আইজিপি, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, শ্রম অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে। কার্যত সকল অভিযোগকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে অভিযুক্ত স্ব পদে বহাল!

শ্রমিক ইউনিয়নের নাম ভাঙ্গিয়ে সভাপতি-সাধারণ শ্রমিকদের কাছ থেকেই চাঁদাবাজি করছে বলে অভিযোগ করেন এবং চাঁদাবাজি বন্ধের জন্য প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন এবং অনতিবিলম্বে উক্ত শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

অপরাধী যে দলের হোক না কেন, সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়।
সম্প্রতি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতির নামে দায়েরকৃত পরিবহন থেকে মালামাল লুটের মামলায় সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক অভিযুক্ত সভাপতি দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে আইনের আওতায় আনার জন্য প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সাধারণ পরিবহন শ্রমিক ও মালিকগন।

সংগঠনের গঠনতন্ত্র যা বলছে:

শ্রমিক ইউনিয়নের গঠনতন্ত্রের ২৪ নং ধারায় নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রনালীতে বলা হয়েছে, প্রতি ৩ বছরের মধ্যে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে ইউনিয়নের কার্যকরী পরিষদের কর্মকর্তা ও সদস্যগণ নির্বাচিত হবেন। কিন্তু ২০১৬ সালের পর শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যকরী পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নাই, তাই জেলার সাধারণ শ্রমিকদের প্রাণের দাবি নির্বাচন এবং নির্বাচনের মাধ্যমে সঠিক নেতৃত্ব বাছাই করার মাধ্যমে, আবার ফেনীর পরিবহন সেক্টরে শান্তির সুবাতাস বইবে।

বিগত সময়ে মোহাম্মদ আলী যা বলেছিলো:

ফেনী জেলা ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি বলেন, বহিরাগত গাড়ীসহ মালামাল আনোয়ার ও হান্নান নামের দুই দালাল আমার মালিকানাধীন ভূঞা ট্রান্সপোর্টে দিয়েছিল। আমার ট্রান্সপোর্টের ম্যানেজার চালান মোতাবেক মালামাল ট্রাকে লোড করে এবং ট্রাকের মালামাল কুমিল্লার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ছেড়ে যাওয়া ট্রাক, লোডকৃত মালামাল, ট্রাকের চালক ও চালকের সহকারী নিখোঁজ। এর প্রেক্ষিতে আমার ট্রান্সপোর্টের ম্যানেজার ফেনী মডেল থানায় অভিযোগ করেন। অভিযোগের দুই দিন পর আমার ও ট্রাকের চালক ও চালকের সহকারীসহ মোট তিনজনের নামে মামলা রুজু করেন হারানো মালের মালিক।

টোকেন চাঁদাবাজির বিষয়ে বলেন, আমার মালিকানাধীন ভূঞা ট্রান্সপোর্টের কোন স্টিকার নাই। লালপোলে আমি ভাড়া জায়গায় আমার সংগঠনের অফিস করেছি এবং দেবীপুরে পুলিশের জায়গায় ‘পুলিশ ক্যান্টিন’ করেছি।

নির্বাচনের বিষয়ে বলেন, ২০১৯ সালে করোনা মহামারির কারণে নির্বাচন হয় নাই পরবর্তীতে বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন কমিশন গঠন করে তফসিল ঘোষণা করেন, কিন্তু আমাদের সংগঠনের ও আমার প্রতিপক্ষরা মামলা করার কারণে নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়।
সম্প্রতি আমার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাটি, টোকেন চাঁদাবাজি ও সরকারি জায়গা দখলের অভিযোগসমূহ আমার প্রতিপক্ষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে করে যাচ্ছেন।