পরশুরাম প্রতিনিধি->>

পরশুরামে গভীর নলকূপ বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলে টাকা নেন তছলিম আহাম্মেদ নামে উপজেলা জাসদের এক নেতা। দুই বছরেও নলকূপ অথবা সেই টাকা ফেরত দিতে না পারায় গ্রামবাসীর তোপের মুখে পড়ে ওই নেতা। এরপর তাঁকে আটক করেন ভুক্তভোগীরা। পরে কিছু টাকা দিয়ে এবং বাকি টাকা পরে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রক্ষা পান তিনি।

রোববার বিকেলে উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ের সামনে এই ঘটনা ঘটে। এ সময় ওই নেতাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত এবং মারধর করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

জাসদ নেতা তছলিম আহাম্মেদ চৌধুরী জাতীয় সমাজ তান্ত্রিক দলের (জাসদ) উপজেলা সহসভাপতি ও ফেনী জেলা জাসদের সাংগঠনিক সম্পাদক।

স্থানীয়রা ও একাধিক ভুক্তভোগী জানান, রোববার বিকেলে ইউএনওর অফিসের বারান্দায় জাসদ নেতাকে পথরোধ করেন স্থানীয় কয়েকজন ভুক্তভোগী। তাঁকে আটকের খবর ছড়িয়ে পড়লে উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে একই অভিযোগ নিয়ে স্থানীয় আলাউদ্দিন আহামেদ চৌধুরী নাসিম কলেজের অফিস সহকারী ছালেহ আহাম্মদ চৌধুরী, সাঈদ চৌধুরীসহ আরও ১০ জন জড়ো হন। তাদের সবার একই অভিযোগ গভীর নলকূপ দেওয়ার কথা বলে তছলিম তাদের কাছ থেকে প্রতিটি নলকূপের জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে ২৫-৩০ হাজার টাকা করে নিয়েছেন। কিন্তু গত দুই বছরেও নলকূপ বরাদ্দ দিতে পারেননি। তাঁকে মোবাইলে কল দিলে তিনি কেটে দেন এবং বিভিন্ন ধরনের টালবাহানা করেন।

পরে ক্ষতিগ্রস্তরা উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের গিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। একে একে ক্ষতিগ্রস্তরা উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলীর কাছে অভিযোগ করেন। এরপর তোপের মুখে ক্ষতিগ্রস্ত দিদারুল আলম ও আমিনুর রহমান নামের দুজনকে ১০ হাজার টাকা ফেরত দিয়েছেন। জাসদ নেতা তছলিম দুজনের কাছ থেকে গভীর নলকূপ বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলে ৫০ হাজার টাকা নিয়েছেন বলে তাঁরা অভিযোগ করেছেন। বাকি টাকা কিছুদিনের মধ্যে ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেখান থেকে ছাড়া পান।

মনছুর আহাম্মদ নামে পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের একজন কর্মচারীর বলেন, ‘আমার কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকা নেওয়ার পরও গত দুই বছর ধরে নলকূপ বরাদ্দ না দেওয়ায় রোববার বিকেলে আমি জাসদ নেতাদেরকে ইউএনও অফিসে বারান্দায় পথরোধ করে ছিলাম। নলকূপ না দিতে পারলে টাকা ফেরতে দিতে চাপ দেই।’ 

উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের জঙ্গলঘোনা গ্রামের দিদারুল আলম বলেন, উপজেলা ও তিনটি ইউনিয়ন এবং পৌর এলাকায় অনন্ত দুই শতাধিক লোকজনের কাছ থেকে ২৫-৩০ হাজার টাকা করে আদায় করেছেন। দুই শ জনের মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, স্থানীয় ইউপি সদস্য, স্কুল-কলেজ শিক্ষক, সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোকজনও রয়েছে।

আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম কলেজের অফিস সহকারী ছালেহ আহাম্মদ চৌধুরী সুজন এবং সাঈদ চৌধুরী, মির্জানগর ইউনিয়ন পরিষদ সাবেক সদস্য ফখরুল ইসলাম ফারুখ, বর্তমান সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ডর সদস্যের স্বামী নুর হোসেন অভিযোগ করেন, জাসদ নেতা তছলিম নলকূপ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ২৫-৩০ হাজার টাকা করে নিয়েছেন। অথচ সরকারিভাবে খরচ হচ্ছে মাত্র ১১ হাজার টাকা।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলীর কাছে অভিযোগ করেন উপজেলা জঙ্গলঘোনা গ্রামের দিদারুল আলম ও তাঁর ভগ্নিপতি আমিনুর রহমান। অভিযোগে তাঁরা জানান, দুজনকে গভীর নলকূপ বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলে তছলিম আহমেদ চৌধুরী ৫০ হাজার টাকা আদায় করেছেন। কিন্তু গত দুই বছর অপেক্ষার পরও নলকূপ বরাদ্দ দিচ্ছেন না। নানা অজুহাতে টালবাহানা করছেন বলে অভিযোগ করেন তাঁরা।

রোববার বিকেলে উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে একই সময় ছালেহ আহাম্মদ চৌধুরী সুজন ও সাঈদ চৌধুরী অভিযোগ করেন, তাদের দুজনের কাছ থেকেও জাসদ নেতারা ৫০ হাজার টাকা করে চারজনের এক লাখ টাকা আদায় করেছেন। কিন্তু গত দুই বছরেও তারা নলকূপ বরাদ্দ পাননি।

মির্জানগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. নুরুজ্জামান ভুট্টো বলেন, ‘গত শনিবার (৬ মে) রাতে সংসদ সদস্য শিরীন আখতারের ছেলে জাসদ নেতা অমিত মনোশিষ মির্জানগর ইউনিয়ন পরিষদের গেলে সেখানেও স্থানীয় একাধিক জনপ্রতিনিধি জাসদ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। তাদের অভিযোগ এমপির কথা বলে গভীর নলকূপ বরাদ্দের নামে টাকা নিয়েও নলকূপ বরাদ্দ দিয়ে টালবাহানা দেখাচ্ছে।’

পরশুরাম উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. ফাহাদ হোসেন ভুইয়া বলেন, ‘গ্রামীণ এলাকায় নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে সারা দেশে ৬ লাখ গভীর ও অগভীর নলকূপ বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান সরকার। তার মধ্যে পরশুরাম উপজেলা ৪৯টি নলকূপ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। রানা এন্টার প্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ পায়। কিন্তু ফেনী-১ আসনের সংসদ সদস্য শিরীন আখতারের বরাদ্দকৃত নলকূপের ৪৯ জনের তালিকার মধ্যে বেশির ভাগ লোকের নাম ও ফোন নম্বরসহ বিভিন্ন তথ্য ভুল থাকায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছিল না।’

অভিযোগের বিষয়ে পরশুরাম উপজেলা জাসদের সহসভাপতি ও ফেনী জেলা জাসদের সাংগঠনিক সম্পাদক তছলিম আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘উপজেলা জাসদের দলীয় কার্যক্রমের খরচ চালানোর জন্য আমাকে শুধুমাত্র ৬টি গভীর নলকূপ বরাদ্দ দিয়েছে। সেগুলোর জন্য আমি কয়েকজনের কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকা নিয়েছি। যেহেতু নলকূপ বরাদ্দ দিতে পারি নাই, তাই দুই একদিনের মধ্যে টাকা ফেরত দিয়ে দিব।’

পরশুরাম উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. ফাহাদ হোসেন ভুইয়া বলেন, ‘এমপি মহোদয়ের কথা বলে এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অফিস খরচের কথা বলে জাসদ নেতারা প্রতিটি নলকূপের জন্য ২৫-৩০ হাজার টাকা করে আদায় করছে। এতে এমপি এবং সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, ‘সরকারি কোষাগারে শুধুমাত্র ভ্যাট ট্যাক্সসহ ১১ হাজার টাকা জমা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। অথচ মিথ্যা তথ্য দিয়ে লোকজনের কাছ থেকে দ্বিগুণ টাকা আদায় করছে।’