বিশেষ প্রতিনিধি->>
১৯ বছরের তরুণ মুস্তাফিজুর রহমানের কাছেই ধরাশায়ী হলো ভারত। অভিষেকেই ৫ উইকেট নিয়ে ভারতকে ৪৬ ওভারে ২২৮ রানে অল আউট করে দিলো টাইগাররা। ৭৯ রানের জয় পেলো বাংলাদেশ।
চার পেসার নিয়েছিল বাংলাদেশ। বিশ্বকাপ ও পাকিস্তানের বিপক্ষে সাফল্য পাওয়া তিন পেসারের সাথে যোগ হয়েছিলেন বাঁ হাতি পেসার মুস্তাফিজ। তাতে একটা কথা উঠলো। প্রথমবারের মতো ওয়ানডেতে চার জেনুইন পেসার কেন খেলাচ্ছে বাংলাদেশ! ম্যাচের মাঝপথেই সেই আলোচনা শেষ করে দিলেন মুস্তাফিজরা। ওয়ানডে ইতিহাসে অভিষেকে সেরা সাফল্যের তালিকায় ৯ নম্বরে নাম মুস্তাফিজের। তাসকিনের পর অভিষেকে ৫ উইকেট নেয়া দ্বিতীয় বাংলাদেশী তিনি।
ভারতের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে মিরপুরে। বাংলাদেশের চোখ ২০১৬ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে। ভারতের বিপক্ষে একটি জয় বাংলাদেশকে র‌্যাঙ্কিংয়ের ৭ নম্বরে তুলে দিতে পারে। তাতে করে ইংল্যান্ডের আসরে বাংলাদেশের খেলাটা নিশ্চিত হতে পারে। সেই শর্ত তো সারা দেশকে আনন্দ আর উৎসবে মাতিয়ে পূরণ করলো টাইগাররা। ২টি ক্যাচ ছাড়লেও ৫টি ক্যাচ নিয়ে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেলেন উইকেটকিপার মুশফিকুর রহিম। ৩ ওয়ানডের সিরিজে ১-০ তে লিড নিয়ে নিলো বাংলাদেশ।
গেলো বছর ভারতকে ধ্বসিয়ে দিয়েছিলেন তাসকিন আহমেদ। অভিষেকেই নিয়েছিলেন ৫ উইকেট। দুঃখ তার, সেই ওয়ানডেতে বাংলাদেশ জিততে পারেনি। স্বপ্নের অভিষেক হয়েছিল যাদের বিপক্ষে তাদের সামনে আবার জ্বলে উঠলেন বাংলাদেশের তরুণ ফাস্ট বোলার। শিখর ধাওয়ান ও বিরাট কোহলিকে আউট করে বাংলাদেশকে চমৎকার ব্রেক থ্রু এনে দিয়েছেন তাসকিন। ৬ রানের মধ্যে দুই উইকেট তুলে নিয়েছেন এই পেসার। দুটি উইকেটই এসেছে উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহিমের সাথে তার যুগলবন্দীতে।

উইকেটের পেছনে এদিন দুটি ক্যাচ ছেড়েছেন মুশফিক। তার মতো উইকেটকিপারের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা না। বোলারদের দায়িত্ব ছিল ৩০৭ রানের পুঁজিটাকে ধরে রেখে জয়ের পথ তৈরি করা। তা করতে গেলে দ্রুত উইকেট পেতে হতো। দ্রুত না হলেও সুযোগ এসেছিল। হাত গলে চলে গেছে তা। দুই ওপেনার মিলে ৯৫ রানের জুটি গড়ে তুলেছিলেন। ধাওয়ানকে (৩০) বিদায় দিয়ে সেই জুটি ভেঙ্গেছেন তাসকিন। পরের ওভারে ব্যক্তিগত ১ রানে ফিরিয়েছেন কোহলিকে।
এরপরের গল্পটা নিজের মতো করে লেখেন মুস্তাফিজুর রহমান। অভিষেক ওয়ানডে খেলতে নেমেছেন। কিন্তু চাপকে জয় করে স্বাভাবিক খেলাটাই উপহার দিয়েছেন। তাসকিন যেখানে ছাড়েন সেখানে শুরু হয় মুস্তাফিজের। ছোটোখাটো এই বাঁ হাতি দেখিয়েছেন ম্যাজিক। প্রথমে রোহিত শর্মাকে অধিনায়ক মাশরাফির ক্যাচ বানিয়েছেন। ৬৩ রান করা রোহিত বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিলেন। পরের ওভারে ফিরে এসে আজিঙ্কা রাহানেকে (৯) তুলে নেন মুস্তাফিজ। স্টেডিয়ামে তখন বাঘের হুঙ্কার।
কোনো উইকেট না হারিয়ে ৯৫ রান করেছিলো ভারত। কিন্তু তারপর বাংলাদেশের আঘাতে তারা বিপর্যস্ত হয়, হয় জর্জরিত। ৬ ব্যাটসম্যান তাদের। এর ৫ ব্যাটসম্যানকেই হারিয়েছে ৯৫ থেকে ১২৮ রানের মধ্যে। ধোনি দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করে দলকে জেতানোয় ওস্তাদ। কিন্তু এদিন তেমনটা হলো না। সাকিব আল হাসান হানেন আঘাত। অফ স্টাম্পের বাইরের বলটাকে খোঁচা দিয়ে ভারত অধিনায়ক এমএস ধোনি উইকেটকিপার মুশফিকের কাছে দিয়েছেন ক্যাচ। ৫ রান করেই ফিরে গেছেন তিনি।
অভিষেক ম্যাচেই ৫ উইকেট নিয়ে নিজের দিকে সবটা আলো নিয়ে গেছেন ছোটোখাটো গড়নের পেসার মুস্তাফিজুর রহমান। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ জেতার মতো পরিস্থিতি গড়ে দেয়ায় তার ভূমিকাটাই সবচেয়ে বেশি। সর্বশেষ আঘাত করেছেন তিনি। এটাও আগেরবারের মতো জোড়া আঘাত। ১২৮ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকা ভারত রাইনা ও জাদেজার জুটিতে ৫০ রান তুলে ফেলেছিল। এই জুটি ভাঙার সাথে হ্যাটট্রিক চান্স তৈরি করেছিলেন। রাইনা (৪০), অশ্বিন (০) তার শিকার এক ওভারে। পরের ওভারে জাদেজাকেও (৩২) তুলে নেন তিনি। অভিষেকটা হয়েছে আলোকিত। বাংলাদেশ গিয়ে দাড়িয়েছে জয়ের দরজায়। ৯.২ ওভার বল করে ৫০ রানে ৫ উইকেট নিয়েছেন মুস্তাফিজ। অভিষেকে ৫ উইকেট নেয়া দ্বিতীয় বাংলাদেশী বোলার তিনি। মুস্তাফিজের কীর্তির পর ভারত আর টিকতে পারেনি। মানতে হয়েছে হার।

টাইগারদের রান কি কিছুটা কম হয়ে গেল! এমন প্রশ্ন উঠেছে তখন যখন ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশ নিজেদের সর্বোচ্চ রান তুলে নিলো। প্রথমবারের মতো ভারতের বিপক্ষে ৩০০ রান তুললো। ৩৭.৪ ওভারে ৪ উইকেটে ২২৯ রান ছিল টাইগারদের। সেই হিসেব কষতে গেলে বাংলাদেশের আরো বেশি রান হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু একসময় মনে হয়েছিল তিনশ রান নাও হতে পারে। তামিম, সৌম্য, সাকিব, সাব্বির, নাসির, মাশরাফির ব্যাটিংয়ে ৩০৭ রান করতে পেরেছে বাংলাদেশ। এই যুগে রানটা খুব বেশি না। কিন্তু বাংলাদেশের নিজেদের মাটিতে খেলা। বাংলাদেশের আশা তাই ছিল বেশি। এক পর্যায়ে ভারত তো ওই রানের চাপেই পড়লো।
বাংলাদেশ টস জিতলো। তারপর তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকারের শুরুটা হয়েছিল ঝড়ের মতো। ভারতের বোলিংকে পাত্তা না দিয়ে রীতিমতো তাণ্ডব শুরু করেছিলেন তারা। একপ্রান্তে তামিম বলেন আমায় দেখ, অন্যপ্রান্তে সৌম্য বলেন আমায়। দুজনের দুরন্ত গতির ব্যাটিংয়ে বিপাকেই পড়ে গিয়েছিল ভারতের বোলিং। ক্ষমাহীন নির্দয় হয়ে উঠেছিলেন তারা। উমেশ যাদবের এক ওভারে ৩টি বাউন্ডারি ও একটি ছক্কা মেরে নিজের মুড বুঝিয়ে দিলেন তামিম। পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ সিরিজে দুটি সেঞ্চুরি আর একটি ফিফটি করেছিলেন তামিম। সেই ফর্মের আলোই মিরপুরের বিকেলে চারদিক আরো আলোকিত করে তুলছিল। পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি করেছিলেন সৌম্য। তিনি যেন যেখানে শেষ করেছিলেন সেখান থেকেই শুরু করেছিলেন। দুজনের আগ্রাসনে বিপন্ন মনে হচ্ছিলো ভারতকে। পাওয়ার প্লেকে দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছেন দুজন। কোনো উইকেট হারায়নি বাংলাদেশ। উঠে এসেছে ৭৯ রান।
এরপরও ঝড়টা চলতে থাকে। বাউন্ডারি মেরে ফিফটি তুলে নেন সৌম্য। তামিমের সাথে ব্যাট করে তার আগে ফিফটি করা একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনাই বটে। কারণ, তামিম কি মুডে ছিলেন তা তো বুঝেছেন ভারতের বোলাররা। কোনোভাবেই যখন এই জুটিকে সামলাতে পারছিল না ভারত তখন ভাগ্য হাত বাড়িয়ে দেয় তাদের দিকে। সৌম্য একটি প্রায় অসম্ভব সিঙ্গেল নিতে ক্রিজ থেকে বের হয়েছিলেন। তামিম ফিরিয়ে দিয়েছেন। রান আউট হয়েছেন সৌম্য। ৪০ বলে ৮টি চার ও ১টি ছক্কার মারে ৫৪ রান নিয়ে ফিরেছেন তিনি। ১৩.৪ ওভার তখন। বাংলাদেশ প্রথম উইকেট হারায় ১০২ রানে। এই রান আবার ভারতের বিপক্ষে ওপেনিং জুটিতে বাংলাদেশের রেকর্ড। আগেরটি ছিলো ৮০ রানের। সেবার তামিমের সাথে ছিলেন ইমরুল কায়েস। সৌম্যকে নিয়ে সেটা ছাড়িয়ে গেলেন তামিম।

তামিম-সৌম্য ঝড় থামার পর মিরপুরে নামে বৃষ্টি। সবাইকে ফিরতে হয় ড্রেসিং রুমে। এমন বৃষ্টি সাধারণত খেলার মানসিকতায় একটা বড় ভূমিকা রাখে। ভারত ছিলো বিপাকে। তারা সুযোগ পেয়েছে নিজেদের ভুল গুলো বাছাই করার। সেই সাথে নতুন পরিকল্পনা কষার সুযোগও পেয়েছে। পরিকল্পনা ঝালাই করে নিয়েছে বাংলাদেশও। কিন্তু এমন বৃষ্টির বাধায় প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্থ হতে হয় একটি দলকে। দূর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের সাতে তাই ঘটলো।
বৃষ্টি যখন নামে তখন বাংলাদেশের রান ১ উইকেটে ১১৯। ৭.৫৯ গড়। ওভার ১৫.৪। তামিম ৫৭ ও অভিষিক্ত লিটন ৩ রানে দাঁড়িয়ে। খেলা আবার শুরু হলো। এবং তামিমের আউটে বোঝা গেল মনোসংযোগে ব্যাঘাত ঘটা একেই বলে। অশ্বিনের বলে রোহিতকে ক্যাচ দিয়ে তামিম ফেরার সময় নামের পাশে ৬০ রান। ৬২ বলে ৭টি চার ও ১টি ছক্কায় ৬০ রান তামিমের।
বৃষ্টির ধাক্কায় ১২৩ থেকে ১৪৬ রানে পৌঁছাতেই শীর্ষ তিন উইকেট হারিয়েছে বাংলাদেশ। অফস্পিনার অশ্বিনই শিকার করেছেন এই তিন উইকেট। প্রথমে তামিমকে বিদায় করেছেন। তারপর লিটন (৮) ও মুশফিকুর রহিম (১৪) বিদায় নিয়েছেন। মুশফিকের আউটটা দায়িত্বহীনতার পরিচয় তুলে ধরেছে। ১৫০তম ম্যাচটায় মনে রাখার মতো কিছু করা হলো না মুশফিকের। অশ্বিনকে অপ্রয়োজনে তুলে মেরেছেন। টাইমিং হয়নি ঠিক মতো। রোহিত সহজ ক্যাচ নিয়েছেন লং অনে। এভাবেই ১৪৬ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে যায় বাংলাদেশ।
সাম্প্রতিক সময়ে ওয়ানডেতে সাব্বির ও সাকিবের জুটি ভালো করে। এই ম্যাচেও তাদের ওপর ছিল দলের নির্ভরতা। দুজনেই ঝুঁকিহীন ক্রিকেট খেলার চেষ্টা করেছেন। রানের গতি ধরে রেখে দলকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। এই চেষ্টায় দুজনার মধ্যে গড়ে ওঠে ৮৩ রানের জুটি। পঞ্চম উইকেটের এই জুটি কক্ষপথেই রাখে বাংলাদেশকে। সাকিব ও সাব্বির দুজনেই ফিফটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু জাদেজার বলে সাব্বির বোল্ড হবার সময় তার রান ৪১। শেষ স্বীকৃত ব্যাটসম্যান জুটি সাকিব ও নাসির। এই দুইয়ে মিলে ৩৮ রানের জুটি গড়লেন। সাকিব ৫২ ও নাসির ৩৪ রান করে আউট হয়েছেন। বাংলাদেশকে তিনশো রানের ওপারে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্বটা টাইগারদের ইনিংসের লেজের। বিশেষ করে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার ২১ রানের জন্যই তেমনটা হতে পেরেছে। – See more at: http://www.kalerkantho.com/online/sports/2015/06/18/235180#sthash.8342zoJr.dpuf