বিশেষ প্রতিনিধি:অবশেষে একরাম হত্যাকাণ্ডে-ফাঁসছেন নিজাম হাজারী সহ বড় দুই দলের আট নেতা ।ফেনীর আলোচিত ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরাম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ফেনী-২এর সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠায় সরকারের হাইকমান্ড ত্যক্ত-বিরক্ত। হাইকমান্ড (ঘটনাপ্রবাহ, তদন্ত, করণীয় নির্ধারণ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি) ফেনী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলোর সত্যতা পেয়েছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
নিজাম হাজারীর পাশাপাশি ফেনী জেলা ও ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সাত নেতাও একরাম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ফেঁসে যাচ্ছেন। পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান থেকে দেশে ফিরলেই নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা। অল্প সময়ে নিজাম হাজারীর উত্থান ও কিভাবে ‘সাম্রাজ্যের’

মালিক হয়েছেন তা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছেন গোয়েন্দারা। নিজেদের রক্ষা করতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ওই নেতারা সরকারের উচ্চপর্যায়ে নানাভাবে তদবির শুরু করে দিয়েছেন।

এদিকে অভিযুক্ত অন্যতম ‘কিলার’ ও নিজাম হাজারীর মামাতো ভাই আবিদুল ইসলাম আবিদকে রক্ষা করতে তার মা আওয়ামী লীগ নেতা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর লায়লা জেসমিন বড় মনি একাধিকবার বৈঠক করেছেন নিজাম হাজারীর সঙ্গে।

রিমান্ডে থাকা আরেক আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদ হোসেন চৌধুরী ওরফে জিহাদ চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়ে চলেছেন। হত্যাকাণ্ডের আগে স্থানীয় আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অবহিত করা হয়েছিল বলে জাহিদ পুলিশের কাছে দাবি করেছেন। অন্যদিকে হত্যাকাণ্ডের আরেক পরিকল্পনাকারী কমিশনার আবদুল্লাহিল মাহমুদ শিবলুকে অনেকটাই জামাই আদরে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি খুন হতে পারে- এমন আগাম তথ্য ফাঁস করায় ফেনীর আলোচিত গডফাদার জয়নাল হাজারীকে জিজ্ঞাসাদের প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশ।
ঢাকা অথবা ফেনীতে জয়নাল হাজারীকে যেকোনো সময় জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। ফুলগাজীর মুন্সীরহাটের আওয়ামী লীগ নেতা ও নিজামের ভাগি্ন জামাই শেখ আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে একরাম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় গতকাল এ নিয়ে নতুন করে তোলপাড় শুরু হয়েছে।

ফেনীর পুলিশ সুপার পরিতোষ ঘোষ কালের কণ্ঠকে বলেন, অত্যন্ত আন্তরিক ও অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে একরাম হত্যাকাণ্ডের ঘাতক ও পরিকল্পনাকারীদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে। রাঘববোয়ালরা যত বড় শক্তিশালীই হোক না কেন তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, টাকা লেনদেনের বিষয়ের রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা চলছে। খুনিদের কেউ রক্ষা করার চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সংশ্লিষ্ট ও গোয়েন্দা সূত্র জানায়, উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরাম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ও পরিকল্পনাকারীদের ধরতে স্থানীয় পুলিশ-র‌্যাবের পাশাপাশি ঢাকা থেকে পুলিশের দুটি বিশেষ টিম তদন্ত চালিয়ে আসছে। খুনিদের আসল গডফাদার কে তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ। ৯ অভিযুক্তকে গ্রেপ্তারের পর সব কিছু ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। আটকদের সবাই প্রকাশ্যে নিজাম হাজারীর মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিত। আবার কয়েকজন আছে, যারা গত উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি নেতা মিনার চৌধুরীর পক্ষে কাজ করেছে। গ্রেপ্তারকৃত ৯ জনই একসময় আলোচিত গডফাদার জয়নাল হাজারীর সঙ্গে কাজ করেছে। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তারা নিজাম হাজারীর ছায়াতলে চলে যায়। এখনো যারা ধরা পড়েনি তারাও নিজামের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত। কিছু অভিযোগের সত্যতা ইতিমধ্যে মিলেছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরাও নির্দেশ দিয়েছেন, তদন্তে যাদের নাম আসবে তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে হবে। কে কোন দল করল তা বিবেচনায় আনা যাবে না।

সূত্র জানায়, সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবীর আদেল, যুবলীগ নেতা জিয়াউল আলম মিস্টার, আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমান, ফুলগাজীর আনন্দপুর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বেলাল উদ্দিন মেম্বার, ফুলগাজীর বিএনপি নেতা মিনার চৌধুরী, একই উপজেলার বিএনপি নেতা সোহেল মজুমদার ও ফুলগাজীর মুন্সীরহাটে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আবদুল্লাহকে বলা হচ্ছে ওই ঘটনার নেপথ্য কারিগর। এ প্রসঙ্গে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, নিজাম হাজারী ও মিনার চৌধুরীর বিরুদ্ধে খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় এমনকি হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত থাকার আলামতও মিলছে। প্রধানমন্ত্রী জাপান থেকে এলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হতে পারে।

হত্যাকাণ্ডের পর পৌর ভবনে বৈঠক : হত্যাকাণ্ডের দিন রাতে ফেনীর পৌরসভা কার্যালয়ের ভেতরে একাধিক ‘ঘাতক’ বৈঠক করে। ওই বৈঠকে নিজাম হাজারী উপস্থিত ছিলেন বলে জানান সেখানে উপস্থিত ছাত্রলীগের এক নেতা। তিনি বলেন, কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া শিবলু, আদেল, মিস্টার, জাহিদ চৌধুরী, আবিদ, সৈকত, নাফিজ উদ্দিন, অনিক, শিপনসহ অন্তত অর্ধশত ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত ছিল। ওই ছাত্রলীগ নেতার দাবি, বৈঠকে খুনিরা লিডারের সহযোগিতা চেয়েছে। তিনিও সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

আবিদের মায়ের তৎপরতা : আবিদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার মা আওয়ামী লীগ নেত্রী লায়লা জেসমিন বড় মনি দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। ফেনীর মাস্টারপাড়ায় নিজাম হাজারীর বাসায় একাধিকবার তাঁর সঙ্গে দেখাও করেছেন। নিজাম হাজারীও তাঁকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। তবে এ বৈঠকের বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।
joynal hajari–সূএ-কালের কণ্ঠ