স্পেশাল | তারিখঃ April 28th, 2023 | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 9832 বার

রাফসান গালিব->>
কিছুদিন আগে দেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি নাম আলোচিত হয়ে উঠেছিল। শুধু আলোচনা নয়, রীতিমতো ঝড় তুলেছিল। নামটি হচ্ছে শাহীন। শুধু শাহীন না, শাহীইইইন। সিলেটের আঞ্চলিক টানে একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক তাঁর ঘরে ডাকাত পড়ার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। সেটির ভিডিও থেকেই বেরিয়ে আসে শাহীন চরিত্রটি। যদিও সেখানে শাহীন নামে কেউ ছিল না।
ভিডিওটিতে দেখা যায়, মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক কী রকম অসমসাহসে ডাকাত দলকে পাকড়াও করেছিলেন, সেটি অভিনয় করে দেখাচ্ছিলেন। তিনি ডাকাতদের ‘নটীর পোলা’ সম্বোধন করে কোনো এক শাহীনকে চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘শাহিইইইইন…নটীর পোলাকে ধরে ফ্যাল!’ শারীরিক অঙ্গভঙ্গি করে নিজেই শাহীনের ভূমিকায় অভিনয় করে পাশে থাকা দুজন বয়স্ক লোককে চেপে ধরেন ওই ভদ্রলোক। এখানে তাঁর বাচনভঙ্গি, চোখেমুখে সাহসিকতা প্রদর্শনের তৃপ্তি আর শারীরিক অঙ্গভঙ্গি অনেকের জন্য হাসির উদ্রেক করে। হাসি এমন একটি জিনিস, সেটি কখন কীভাবে সংক্রমিত হয়ে যায়, তা বোঝা মুশকিল হয়ে যায়। এই ভিডিওর ক্ষেত্রে আমরা দেখি, তুমুল বেগে হাসি সংক্রমিত হয়ে পড়েছিল নেট দুনিয়ায়।
কেন এমন ভিডিও ভাইরাল হলো, সেখানে ভাইরাল হওয়ার এমন কী আছে—এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। পত্রিকায় উপসম্পাদকীয় লেখা হয়েছে। তবে ফেসবুকে বেশ কিছুদিন ‘শাহীন’ নামটি যে প্রভাব বিস্তার করেছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অদেখা বা অজানা এক শাহীন হয়ে উঠেছিল এক বীরপুরুষ। এ অস্থির সময়ে যার ওপরে ভরসা রাখতে চায় মানুষ। নয়তো কেন অনেককেই আমরা বলতে দেখি শাহীইইইন…দুর্নীতিবাজদের ধরে ফ্যাল; শাহীইইইন…ব্যাংক ডাকাতদের ধরে ফ্যাল; শাহীইইইন…ভোটচোরকে ধরে ফ্যাল; শাহীইইইন…ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে ধরে ফ্যাল—এমন আরও ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক আকাঙ্ক্ষা।
কিন্তু এই শাহীন কে? তিনি নিশ্চয়ই উড়ে এসে জুড়ে বসা কেউ নন। আপামর জনসাধারণের ভেতর থেকেই উঠে আসা কোনো সাহসী চরিত্র। যাহোক, সেই শাহীন আসলে স্বপ্ন, ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষার খাঁচাতেই বন্দী থাকেন। তাঁর দেখা কখনো মেলে না। বিষয়টি কি এমন—অনেকে নিজেরাই একেকজন শাহীন হয়ে উঠতে চান, কিন্তু পারেন না। কারণ, শাহীন যাকে বা যাদের ধরে ফেলার কথা, তার বা তাদের কাছেই তারা আসলে পরাস্ত।
এমন একজন ‘পরাস্ত’ শাহীনের দেখাই আমরা পেলাম, যিনি ফেনী থেকে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে ফেনী—অনেকগুলো হাসপাতালে ঘুরে একটি আইসিইউ শয্যা পেলেন না। বিনা চিকিৎসায় মরে যেতে এক প্রকার ‘বাধ্য’ হলেন। শাহীন এই ‘হতভাগা’ রাষ্ট্রের একজন হতদরিদ্র নাগরিক। যিনি ফেনী সদর উপজেলার মোটবি ইউনিয়নের বাসিন্দা। ৩৮ বছর বয়সী শাহীন ২৩ এপ্রিল রোববার অর্থাৎ, পবিত্র ঈদুল ফিতরের পরদিন সকালে ফেনী শহরের অদূরে এক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মাথায় মারাত্মকভাবে আঘাত পান। গাছের সঙ্গে ধাক্কায় তাঁর মাথার একাংশ থেঁতলে যায়।
জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চলে যাওয়া শাহীনকে বাঁচাতে তাঁর পরিবার, স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা কত চেষ্টাই না করেছেন। এক শহর থেকে আরেক শহরে, সারা দিন সারা রাত ধরে অ্যাম্বুলেন্স করে ঘুরে বেড়িয়েছেন। কিন্তু দেশের সবচেয়ে বড় দুটি শহরে তাঁর জন্য একটি আইসিইউ শয্যা জোগাড় করা যায়নি।
শাহীনকে বাঁচানোর জন্য স্বজনদের যে যুদ্ধ ও সেই যুদ্ধে তাঁদের কী অসহায় পরাজয় প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিবেদক সেলিম জাহিদ আমাদের সামনে হাজির করলেন, তা পড়ে স্তম্ভিত হয়ে যাই। বাকরুদ্ধ হয়ে যাই।
করোনা মহামারিতে আইসিইউ শয্যার জন্য মানুষের আহাজারি দেখা গিয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একের পর এক পোস্টে কারও মা বা বাবা, পরিবারের স্বজনদের জন্য একটি আইসিইউ শয্যা পেতে আকুতি কোনোভাবেই ভোলার নয়। একটি আইসিইউ শয্যা পেতে রোগী নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে দৌড়াতে দৌড়াতে একপর্যায়ে এমন পোস্টও আমরা দেখেছি—আইসিইউ সিট আর লাগবে না! অ্যাম্বুলেন্সেই কত রোগী মারা গেল সে সময়।
এমন দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা আমরা পার করে এসেছি। কিন্তু এখনো কেন আইসিইউ–সংকট থাকবে। এখনো কেন একটি আইসিইউ শয্যা পেতে হয়রান হয়ে এক শহর থেকে আরেক শহরে ঘুরতে ঘুরতে শাহীনকে মরে যেতে হয়।
এক করোনা মহামারি এসে আমাদের দেখিয়ে দিল, এ দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভেতরটা কতটা ফাঁপা। শুধু তাই নয়, সেটি ছিল মিথ্যার বেসাতি দিয়ে ফোলানো বেলুন। তখন অনেকের বক্তব্য ছিল, করোনা মহামারি থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। এ নিয়ে নীতিনির্ধারক মহলেও নানা প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি বর্ষিত হয়েছিল। সব কিছুই যেন ছেলে ভোলানো গল্পে পরিণত হয়েছে।
করোনার প্রথম ধাক্কার শুরুতে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল দেশের প্রতিটি জেলায় আইসিইউ ইউনিট গড়ে তুলতে।
করোনা সংক্রমণের একের পর এক ঢেউয়ের ধাক্কায় কাঁপল ঠিকই, কিন্তু সেই নির্দেশনা আজও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলো না। আজ (২৮ এপ্রিল) প্রথম আলোর প্রধান খবরে উঠে এসেছে, দেশের কমপক্ষে ২২ জেলায় সরকারিভাবে আইসিইউ সেবা নেই। এমনকি রাজধানীর একাধিক বড় সরকারি হাসপাতালেও আইসিইউ শয্যা নেই।বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ শয্যা থাকলেও তা এত ব্যয়বহুল যে শাহীনের মতো হতদরিদ্র ব্যক্তিদের পক্ষে সেই খরচ মেটানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
বিদ্যুৎ মিস্ত্রি শাহীনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার রুগ্ণ চেহারা আবারও ভেসে উঠল। স্বাস্থ্য খাতে যে উন্নয়নের ‘গপ্পো’ আমরা শুনি, তা নিয়ে আমাদের সন্দেহ করতেই হয়।
স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া এ দেশের নাগরিকের মৌলিক অধিকার হলেও, সেই অধিকার আপামর জনগোষ্ঠীর জন্য এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। দরিদ্র হওয়াটাই কি ছিল শাহীনের অপরাধ? বৈধ বা অবৈধ উপায়ে ধনী হয়ে উঠতে পারলে হয়তো এই শাহীনের একটি আইসিইউ শয্যা পেতে অসুবিধা হতো না। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে রাজনৈতিকভাবে বা অন্য কোনোভাবে প্রভাবশালী বা ক্ষমতাবান হলে বা তাদের কাছের মানুষ হলেও শাহীনের জন্য একটি আইসিইউ শয্যা জোগাড় হয়ে যেত। কিন্তু হায়, শাহীন তেমন কেউ নন।
এ রাষ্ট্রের এ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে বৈষম্য, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, নির্মমতা, নির্বিকারতা ঢুকে পড়েছে, তার কাছে পরাজিত হতে হয় শাহীনকে। এই শাহীনের কাউকে আর ধরা হয় না। তিনি নিজেই ধরা পড়ে যান।
সূত্র : রাফসান গালিব, সম্পাদকীয় সহকারী, প্রথম আলো
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
- ফেনীতে পিটু বাহিনীর প্রধান যুবলীগ নেতা পিটু ‘আটক’
- ফেনীতে আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবসে আলোচনা সভা
- ফুলগাজীতে গাঁজাসহ নারী ও কিশোর গ্রেপ্তার
- ফেনীতে ১৫ বছরে ৮০ হাজার উপকারভোগী পেয়েছে ৫৫৩ কোটি টাকা
- ফেনীর প্রতারণা মামলায় চাকরিচ্যুত কারারক্ষী কুমিল্লায় গ্রেপ্তার
- দাগনভূঞার সাজাপ্রাপ্ত আসামী আব্দুল হাই সবুজ ঢাকায় গ্রেপ্তার
- পরশুরাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীর খাবারের অর্থ বরাদ্দ বাড়লেও বাড়েনি মান
- ফেনীতে পুত্রবধূ হত্যায় শাশুড়ি গ্রেপ্তার
- ঢাকায় সন্ত্রাসী হামলায় ভুবনের মৃত্যু, ফেনীতে প্রতিবাদ
- অধিকারের আদিলুর ও এলানের মুক্তির দাবিতে ফেনীতে মৌন প্রতিবাদ ও মানববন্ধন
Leave a Reply